![]() |
ছবি :- পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পাঠ্যপুস্তক |
লেখক :- রাজশেখর বসু
যাদের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ক বাংলা গ্রন্থ বা প্রবন্ধ লেথা হয় তাদের মােটামুটি দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে । প্রথম , যারা ইংরেজি জানে না বা অতি অল্প জানে । অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়ে এবং অশিক্ষিত বয়স্ক লােক এই শ্রেণিতে পড়ে । দ্বিতীয়, যারা ইংরেজি জানে এবং ইংরেজি ভাষায় অধিক বিজ্ঞান পড়েছে ।
প্রথম শ্রেণির পাঠকদের বিজ্ঞানের সঙ্গে পূর্ব পরিচয় নেই । গুটিকতক ইংরেজি পারিভাষিক শব্দ হয়তাে তারা শিখেছে , যেমন টাইফয়েড , আয়ােডিন , মােটর , ক্লোটন , জেব্রা । অনেক রকম স্মৃল তথ্যও তাদের জানা থাকতে পারে , যেমন জল আর কপূর উবে যায় , পিতলের চাইতে আলিউমিনিয়াম হালকা , লাউ , কুমড়ো জাতীয় গাছে দুরকম ফুল হয় । এই রকম সামান্য জ্ঞান থাকলেও সুশৃঙ্খল আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্য তারা কিছুই জানে না । এই শ্রেণির পাঠক ইংরেজি ভাষার প্রভাব থেকে মুক্ত , সেজন্য বাংলা পরিভাষা আয়ত্ত করে বাংলায় বিজ্ঞান শেখা তাদের সংস্কারের বিরােধী নয় । ছেলেবেলায় আমাকে বহ্মমােহন মল্লিকের বাংলা জ্যামিতি পড়তে হয়েছিল । 'এক নির্দিষ্ট সীমাবিশিষ্ট সরলরেখার উপর এক সমবাহু ত্রিভুজ অঙ্কিত করিতে হইবে ’ - এর মানে বুঝতে বাধা হয়নি , কারণ ভাষাগত বিরােধী সংস্কার ছিল না । কিন্তু যারা ইংরেজি জিওমেট্রি পড়েছে তাদের কাছে উক্ত প্রতিজ্ঞাবাক্যটি সুশ্রাব্য ঠেকবে না , তার মানেও স্পষ্ট হবে না । যে লােক আজন্ম ইজাব পরেছে তার পক্ষে হঠাৎ ধুতি পরা অভ্যাস করা একটু শক্ত । আমাদের সরকার ক্রমে ক্রমে রাজকার্যে দেশি পরিভাষা চালাচ্ছেন , তাতে অনেকে মুশকিলে পড়েছেন , কারণ তাদের নূতন করে শিখতে হচ্ছে ।
পূর্বোক্ত প্রথম শ্রেণির পাঠক যখন বাংলায় বিজ্ঞান শেখে তখন ভাষার জন্য তার বাধা হয় না , শুধু বিষয়টি যত্ন করে বুঝতে হয় । পাশ্চাত্ত্য দেশের শিক্ষার্থীর চেয়ে তাকে বেশি চেষ্টা করতে হয় না । কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠক যখন বাংলা ভাষায় লেখা বৈজ্ঞানিক সন্দর্ভ পড়ে তখন তাকে পূর্ব সংস্কার দমন করে ( অর্থাৎ ইংরেজির প্রতি অতিরিক্ত পক্ষপাত বর্জন করে ) প্রীতির সহিত মাতৃভাষার পদ্ধতি আয়ত্ত করতে হয় । এই কারণে পাশ্চাত্য পাঠকের তুলনায় তার পক্ষে একটু বেশি চেষ্টা আবশ্যক ।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় এখনও নানা রকম বাধা আছে । বাংলা পারিভাষিক শব্দ প্রচুর নেই । অনেক বৎসর পূর্বে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বিদ্যোৎসাহী লেখক নানা বিষয়ের পরিভাষা রচনা করেছিলেন । তাদের উদযােগের এই ত্রুটি ছিল যে তারা একযােগে কাজ না করে স্বতন্ত্রভাবে করেছিলেন , তার ফলে সংকলিত পরিভাষার সাম্য হয়নি , একই ইংরেজি সংজ্ঞার বিভিন্ন প্রতিশব্দ রচিত হয়েছে । ১৯৩৬ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যে পরিভাষাসমিতি নিযুক্ত করেছিলেন তাতে বিভিন্ন বিজ্ঞানের অধ্যাপক , ভাষাতত্ত্বজ্ঞ , সংস্কৃতঙ্গ পণ্ডিত এবং কয়েকজন লেখক একযােগে কাজ করেছিলেন , তার ফলে তাদের চেষ্টা অধিকতর সফল হয়েছে ।
পরিভাষা রচনা একজনের কাজ নয় , সমবেতভাবে না করলে নানা ত্রুটি হতে পারে । কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকলন খুব বড়াে নয়, আরও শব্দের প্রয়ােজন আছে এবং তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা করা আবশ্যক । কিন্তু দরকার মতন বাংলা শব্দ পাওয়া না গেলেও বৈজ্ঞানিক রচনা চলতে পারে । যতদিন উপযুক্ত ও প্রামাণিক বাংলা শব্দ রচিত না হয় ততদিন ইংরেজি শব্দই বাংলা বানানে চালানাে ভালাে । বিশ্ববিদ্যালয় - নিযুক্ত সমিতি বিস্তর ইংরেজি শব্দ বজায় রেখেছেন । তারা বিধান দিয়েছেন যে নবাগত রাসায়নিক বস্তুর ইংরেজি নামই বাংলা বানানে চলবে , যেমন অক্সিজেন , প্যারাডাইক্লোরােবেনন। উদ্ভিদ ও প্রাণীর জাতিবাচক বা পরিচয়বাচক অধিকাংশ ইংরেজি ( বা সার্বজাতিক , international ) নামও বাংলায় চালানাে যেতে পারে , যেমন ম্যালভাসি , ফার্ন , আরথ্রোপােড়া ইনসেক্ট ।
পাশ্চাত্য দেশের তুলনায় এদেশের জনসাধারণের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নগণ্য । প্রাথমিক বিজ্ঞানের সঙ্গে কিঞ্চিৎ পরিচয় না থাকলেও কোনাে বৈজ্ঞানিক সন্দৰ্ভ বােঝা কঠিন । ইওরােপ আমেরিকায় পপুলার সায়েন্স লেখা সুসাধ্য এবং সাধারণে তা সহজেই বােঝে । কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থা তেমন নয় , বয়স্কদের জন্য যা লেখা হয় তাও প্রাথমিক বিজ্ঞানের মতন গােড়া থেকে না লিখলে বােধগম্য হয় না । জনসাধারণের জন্য যারা বাংলায় বিজ্ঞান লেখেন তারা এ বিষয়ে অবহিত না হলে তাঁদের লেখা জনপ্রিয় হবে না । অবশ্য কালক্রমে এ দেশে বিজ্ঞান শিক্ষার বিস্তার হলে এই অসুবিধা দূর হবে , তখন বৈজ্ঞানিক সাহিত্য রচনা সুসাধ্য হবে ।
বিজ্ঞান আলােচনার জন্য যে রচনাপদ্ধতি আবশ্যক তা অনেক লেখক এখনও আয়ও করতে পারেননি , অনেক স্থলে তাদের ভাষা আড়ষ্ট এবং ইংরেজির আক্ষরিক অনুবাদ হয়ে পড়ে । এই দোষ থেকে মুক্ত না হলে বাংলা বৈজ্ঞানিক সাহিত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হবে না । অনেক লেখক মনে করেন , ইংরেজি শব্দের যে অর্থব্যাপ্তি বা connotation , বাংলা প্রতিশব্দেরও ঠিক তাই হওয়া চাই , এজন্য অনেক সময় তারা অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ প্রয়ােগ করেন । ইংরেজি sensitive শব্দ নানা অর্থে চলে, যেমন sensitive person , wound , plant , balance , photographic paper ইত্যাদি । বাংলায় অর্থভেদে বিভিন্ন শব্দ প্রয়ােগ করাই উচিত , যেমন অভিমানী , ব্যথাপ্রবণ , উত্তেজী , সুবেদী , সুগ্রাহী । Sensitized paper- এর অনুবাদ স্পর্শকাতর কাগজ অতি উৎকট , কিন্তু তাও কেউ কেউ লিখে থাকেন । সুগ্রহী কাগজ লিখলে ঠিক হয় ।
অনেক লেখক তাদের বক্তব্য ইংরেজিতে ভাবেন এবং যথাযথ বাংলা অনুবাদে প্রকাশ করবার চেষ্টা The atomic enginc has not even reached the blue print stage — পরমাণু এঞ্জিন নীল চিত্রের অবস্থাতেও পৌঁছায়নি । এ রকম বর্ণনা বাংলা ভাষায় প্রকৃতিবিরুব্দ । একটু ঘুরিয়ে লিখলে অর্থসরল হয় — পরমাণু এঞ্জিনের নকশা পর্যন্ত এখনও প্রস্তুত হয়নি । When sulphur burns in air the nitroge does not take part in the reaction - “ যখন গন্ধক হাওয়ায় পােড়ে তখন নাইট্রোজেন প্রতিক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করে না । এ রকম মাছিমারা নকল না করে নাইট্রোজেনের কোনাে পরিবর্তন হয় না লিখলে বাংলা ভাষা বজায় থাকে ।
অনেকে মনে করেন পারিভাষিক শব্দ বাদ দিয়ে বক্তব্য প্রকাশ করলে রচনা সহজ হয় । এই ধারণা পুরােপুরি ঠিক নয় । স্থান বিশেষে পারিভাষিক শব্দ বাদ দেওয়া চলে , যেমন ‘ অমেরুদণ্ডী’র বদলে লেখা যেতে পারে , যেসব জন্তুর শিরদাঁড়া নেই । কিন্তু “ আলােকতরঙ্গ'র বদলে আলাের কাপন বা নাচন লিখলে কিছু মাত্র সহজ হয় না । পরিভাষার উদ্দেশ্য ভাষার সংক্ষেপ এবং অর্থ সুনির্দিষ্ট করা । যদি বার বার কোনাে বিষয়ের বর্ণনা দিতে হয় তবে অনর্থক কথা বেড়ে যায় , তাতে পাঠকের অসুবিধা হয় । সাধারণের জন্য যে বৈজ্ঞানিক সন্দর্ভ লেখা হয় হাতে অল্প পরিচিত পারিভাষিক শব্দের প্রথমবার প্রয়োগের সময় তার ব্যাখ্যা ( এবং স্থলবিশেষে ইংরেজি নাম ) দেওয়া আবশ্যক , কিন্তু পরে শুধু বাংলা পারিভাষিক শব্দটি দিলেই চলে ।
আমাদের আলংকারিকগণ শব্দের ত্রিবিধ কথা বলেছেন — অভিধা , লক্ষণ ও ব্যঞ্জনা । প্রথমটি শুধু আভিধানিক অর্থ প্রকাশ করে , যেমন ‘ দেশ’এর অর্থ ভারত ইত্যাদি , অথবা স্থান । কিন্তু দেশের লজ্জা ’ — এখানে লক্ষণীয় দেশের অর্থ দেশবাসীর । অরণ্য’এর আভিধানিক অর্থ বন , কিন্তু ' অরণ্যে রােদন ’ বললে ব্যঞ্জনার অর্থ হয় নিস্লফ খেদ । সাধারণ সাহিত্যে লক্ষণা বা ব্যঞ্জনা এবং উৎপ্রেক্ষা অতিশয়ােক্তি প্রভৃতি অলংকারের সার্থক প্রয়ােগ হতে পারে , কিন্তু বৈজ্ঞানিক সাহিত্যে যত কম থাকে ততই ভালাে । উপমার কিছু প্রয়ােজন হয় , রূপকও স্থলবিশেষে চলতে পারে , কিন্তু অন্যান্য অলংকার বর্জন করাই উচিত। হিমালয় যেন পৃথিবীর মানদন্ড — কালিদাসের এই উক্তি কাব্যেরই উপযুক্ত , ভূগােলের নয় । বৈজ্ঞানিক প্রসঙ্গের ভাষা অত্যন্ত সরল ও পষ্ট হওয়া আবশ্যক — এই কথাটি সকল লেখকেরই মনে রাখা উচিত ।
বাংলা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধদিতে আর একটি দােষ প্রায় নজরে পড়ে । অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী এই প্রবাদটি যে কত ঠিক তার প্রমাণ আমাদের সাময়িকপত্রাদিতে মাঝে মাঝে পাওয়া যায় । কিছুদিন আগে একটি পত্রিকায় দেখেছি- “ অক্সিজেন হাইড্রোজেন স্বাস্থ্যকর বলে বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই । তারা জীবের বেঁচে থাকবার পক্ষে অপরিহার্য অঙ্গ মাত্র । তবে ওজন গ্যাস স্বাস্থ্যকর । এই রকম ভূল লেখা সাধারণ পাঠকের পক্ষে অনিষ্টকর।সম্পাদকের উচিত অবিখ্যাত লেখকের বৈজ্ঞানিক রচনা প্রকাশের আগে অভিজ্ঞ লােককে দিয়ে যাচাই করে নেওয়া ।
